❝ইখলাসের উত্তরাধিকার একটি ইহতেমামীর আত্মকথা❞ 2025

❝ইখলাসের উত্তরাধিকার ;একটি ইহতেমামীর আত্মকথা❞
মুফতি দীদার ফাহাদ রাহমানী
একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা গড়ে ওঠে শতাব্দীর প্রেরণায়, পূর্বসূরিদের নিরলস সাধনায়। আর সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব কাঁধে তোলা—এ যেন শুধু কর্তব্য নয়, বরং একটি জীবন্ত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। কালিয়া দারুল কুরআন মাদরাসা—নামটি উচ্চারণ করতেই হৃদয়ে গম্ভীর এক কাঁপন জাগে, অনুভব করি কতশত শ্রম-ঘাম-দোয়ার সংমিশ্রণে তৈরি এই কাঠামো আজ আমার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের ইহতেমামীর দায়িত্ব যখন আমার কাঁধে অর্পিত হলো, তখন থেকেই চারপাশে নানান শঙ্কা আর সংশয়ের ছায়া ঘুরে বেড়াতে লাগল। “বয়সের ভারে এই দায়িত্ব নিতে গেলে ভাবতে হবে বারবার”—এমন কথাও শুনতে হয়েছে। কিন্তু ভয় যতই থাকুক, আমার ভিতরে সাহস জোগান এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁদের কথা মনে পড়লেই বুকটা দৃঢ় হয়।
প্রথমেই বলব আমার প্রিয় বাবা—তিনি আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক, চরিত্র গঠনের প্রথম ভিত্তি। তাঁর নিরব দায়িত্বশীলতা, কথার চেয়ে কাজে বেশি মনোযোগ দেওয়া এবং দৃঢ় মানসিকতা—এইসব গুণ আমাকে সাহস জুগিয়েছে শিকড়ের মতো। আমার পাশে ছিলেন আমার পাঁচ ভাই—প্রত্যেকে একেকটি আস্থা ও সাহসের স্তম্ভ। আর ছিলেন আমার ভগ্নিপতি, একজন বিদগ্ধ আলেম, যাঁর চিন্তাশীল দিকনির্দেশনা ও প্রশান্ত-ভাষা আমাকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা দিয়েছেন।
তবে ইহতেমামীর এই সময়ে আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠেছে—দায়িত্বের অর্থ কী, কেমন করে একটি প্রতিষ্ঠান ভালোবাসায় গড়া যায়—তা হাতে-কলমে শেখা দুইজন গুণী মানুষ।
একজন দূরদর্শী রাহনুমা; মাওলানা মাহফুজুল হক হাফিজাহুল্লাহ,
বেফাকুল মাদারিসের মহাসচিব, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া/আজিজিয়া’র শায়খুল হাদিস ও মুহতামীম। তাঁর নেতৃত্বে কিতাব বিভাগে আমি শিক্ষার্থী ছিলাম। তখনই দেখেছি, কীভাবে একজন মানুষ তাঁর ইখলাস, মেধা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাণ দিতে পারেন।
তাঁর চিন্তা ছিল গভীর, সুদূরপ্রসারী, আর বাস্তবায়নে ছিল নিখুঁতত্ব। তাঁর জীবনযাপন ছিল সাদাসিধে, কিন্তু প্রতিটি কাজে ছিল দৃঢ়তা ও পরিপক্বতা। ছোট থেকে বড়—সব বিষয়ই তাঁর দৃষ্টির আওতায় আসত। সেইসাথে, তাঁর মুখের স্নিগ্ধ হাসি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে দিত এক প্রশান্তিময় শীতলতা। আমি বলতেই পারি—হুজুর ছিলেন দায়িত্বশীলতার এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁকে দেখে আমি শিখেছি—কীভাবে দায়িত্ব শুধু পালন নয়, বরং তা ছড়িয়ে দিতে হয় প্রেরণার রূপে।
আদর্শের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা ; মাওলানা কামরুল ইসলাম মুসা সাহেব শাফাহুল্লাহ।
তিনি ছিলেন আমার শুরুর পথের রাহবার, হিফজ শুরুর সময় থেকেই আমি তাঁর অধীনে পরিচালিত হয়েছি। তাঁর হাতে গড়া মা’হাদ উলুমিল কুরআন ছিল আমার প্রথম আদর্শভূমি।
হুজুরের সবচেয়ে প্রভাবশালী দিক ছিল—নির্বিকল্প সিদ্ধান্ত, সুসংহত নেতৃত্ব ও চিন্তার স্বচ্ছতা। এককথার মানুষ ছিলেন তিনি। কথায় ও কাজে ছিল পূর্ণ সামঞ্জস্য। তাঁর কাছে প্রতিটি ছাত্র ছিল স্বপ্নের অংশীদার। একবার মাহাদের ৪০ দিন বাইরে না যাওয়ার পুরস্কার হিসেবে তিনি আমাকে হাদিয়া দেন—মাওলানা মহিউদ্দিন খান রহ. রচিত “জীবনের খেলাঘরে”। এই বইটা থেকে আমি শুধু গল্প নয়, শিখেছি—কীভাবে একটুখানি সজাগ মনোযোগে একটি ছাত্রকে উজ্জীবিত করা যায়, কীভাবে অনুপ্রেরণা দেওয়া যায় নিঃশব্দে, গভীরভাবে।
আরো মনে পড়ে—মাদরাসার জুতা রাখার জায়গায় যখন বিশৃঙ্খলা দেখা যেত, তখন হুজুর নিজ হাতে জুতা গুছিয়ে রাখতেন। যেন চোখের সামনে ছাত্ররা শেখে—দায়িত্ব বলতে কেবল বলা নয়, সেটা বাস্তবে করে দেখানো।
একবার গরমকালে, এক প্রাক্তন ছাত্র এসে তাঁর অফিসে এসি লাগানোর প্রস্তাব দেয়। হুজুর রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বললেন, “ছাত্ররা যখন টিনশেডে পড়ে আছে, আমি তখন এসির নিচে বসব? এটা কী করে সম্ভব?” তিনি শুধু নিজে ছাড় দেননি, অফিসের ফ্যানের জেনারেটর লাইন পর্যন্ত খুলে ফেলেন। এটাই ছিল তাঁর শিক্ষা—প্রত্যেকটি দায়িত্ব মানে আত্মত্যাগ।
এই দুই ব্যক্তিত্বের ছায়াতলে বেড়ে উঠা, তাঁদের প্রতিটি আচরণ আমার ভেতরে গেঁথে গেছে। আজ আমি যে দায়িত্ব নিয়েছি, তা যেন তাঁদের ছায়া থেকেই ধার করা এক আলোর ধারা। আমি দোয়া করি, এই দুই আদর্শবান মানুষের প্রেরণায় কালিয়া দারুল কুরআন মাদরাসা আগামীর পথে হেঁটে যাক দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে, ইখলাসের আলোতে দীপ্ত হয়ে।
২৬ এপ্রিল ২০২৫ | কালিয়া দারুল কুরআন মাদরাসা ও কালিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, দশআনি, বাগেরহাট